শসার পরিচিতি
বাংলা নামঃ শসা
ইংরেজী নামঃ Cucumber
বৈজ্ঞানিক নামঃ Cucumis
sativus
পরিবারঃ Cucurbitaceae
শসা একটি জনপ্রিয় সবজি। এটি বিশ্বের সব দেশেই জন্মে। শসার সব জাতই লতানো,তবে কিছু সংখ্যক জাতের কান্ড তেমন দীর্ঘ প্রসারী নয়। কোন কোন এলাকায় এগুলোকে খিরা বলে। শসার কান্ড ও পাতা খস্খসে তীক্ষ্ম লোমে আবৃত। ফুল হলুদ ও ক্ষুদ্রাকার এবং পাতার কক্ষে গুচ্ছাকারে উৎপন্ন হয়। পুরুষ ও স্ত্রী ফুল সাধারণতঃ আলাদা কক্ষে থাকে। শসার সাধারণ জাতের ফল বেলুনাকার ও বর্ণে হালকা সবুজ, খিরার ফল প্রায় গোলাকার এবং পাকার পর এদের ত্বক জালের আকারে ফেটে যায়। কচি শসার সালাদ খুবই মুখরোচক। এ ছাড়া শসা তরকারী হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এটা হজমে ও কোষ্ঠ কাঠিন্যে উপকারী। পাকা শসার পায়েশ ও মোরব্বা সুস্বাদু|
মাটি ও জলবায়ু
বন্যামুক্ত দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে শসা ভাল হয়। শসা পানি বদ্ধতা সহ্য করতে পারেনা। কাজেই জমিতে পানি নিস্কাশনের সুবিধা থাকা দরকার। শসার জন্য উচ্চ তাপমাত্রা প্রয়োজন। গড়ে ২৫ ডিগ্রী সেঃ তাপমাত্রায় ইহা সবচেয়ে ভাল জন্মে। ইহার কোন কোন জাত আর্দ্র পরিবেশে সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সঠিক জাত নির্বাচন করে লাগাতে পারলে বাংলাদেশে যে কোন সময়ই শসা জন্মানো যায়। খিরা কেবলমাত্র রবি মৌসুমেই জন্মে।
জাত
রংপুর ও চট্টগ্রামের স্থানীয় জাত। তাছাড়া, চাষের জন্য জাপান থেকে কয়েকটি জাত আমদানী করা হচ্ছে। শসা দু’ধরনেরঃ পালা শসা ও ভুঁয়ে শসা ।
বীজ বপনের সময় ও পরিমাণ
|
মৌসুম |
বীজ লাগানোর সময় |
বীজের পরিমাণ (কেজি/হেঃ) |
|
খরিপ মৌসুম-১ |
মাঘের ১৫ থেকে জৈষ্ঠের মাঝামাঝি |
১.০ |
|
খরিপ মৌসুম-২ |
ভাদ্রের ১৫ থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি |
০.৪ - ০.৬ |
|
রবি |
কার্তিক থেকে পৌষের মাঝামাঝি |
০.৪ - ০.৬ |
চারা যদি পলিথিন ব্যাগে উৎপাদন করা হয় তাহলে উপরে উল্লেখিত মোট বীজের ৪০-৫০% দরকার হবে।
বেড বা কেয়ারীর আকার
২৫০ সেঃ মিঃ চওড়া এবং এর দৈর্ঘ্য জমির দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। বেডের চারদিকে ৩০ সেঃমিঃ চওড়া ও ২০ সেঃমিঃ গভীর করে নালা তৈরী করতে হবে।
রোপন দূরত্ব
সারি থেকে সারির দূরত্ব ২০০ সেঃমিঃ এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২০০ সেঃমিঃ এবং মাদার আকার ৩০ সেঃমিঃ চওড়া, ৩০সেঃমিঃ লম্বা ও ৩০সেঃমিঃ গভীর হবে।
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
সারের পরিমান
|
সারের নাম
|
সারের পরিমান (হেঃ প্রতি) |
|
গোবর |
০৫ টন |
|
খৈল |
২৮০ কেজি |
|
টিএসপি |
১৫০ কেজি |
|
এমপি |
১০০ কেজি |
সার ব্যবহারের নিয়ম
বীজ বোনার ৭-৮দিন আগে সব সার গর্তের মাটির সাথে মিশাতে হবে।
বীজ বপন ও সার উপরি প্রয়োগ
বীজ বপন
প্রতি মাদায় ৪-৫টি বীজ লাগাতে হবে। বীজ একদিন ও একরাত ভিজিয়ে লাগানো ভাল।
সার উপরি প্রয়োগ
বীজ বোনার ২০-২৫ দিন পর হেক্টরপ্রতি ৫০ কেজি ইউরিয়া এবং প্রায় দেড় মাস পর আরও ৫০ কেজি সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
পানি সেচ
শুকনো মৌসুমে মাঝে মাঝে সেচ দেয়া ভাল। বর্ষাকালে পানি নিকাশের জন্য নালার বন্দোবস্ত রাখতে হবে।
মাচা তৈরী ও জমিতে খড় বিছানো
শসার গাছ যখন ১০-১৫ সেঃমিঃ লম্বা হবে তখন ১-১.৫ মিটার উচু করে শক্ত মাচা দিতে হবে। যখন বেশী জমিতে শসার চাষ করা হবে তখন ব্যায় বহুল বলে মাচা না দিয়ে ধানের খড় জমির উপর সমান ভাবে বিছিয়ে দিতে হবে। এতে শসা ধানের খড়ের উপর থাকবে এবং পঁচবে না বা পোকার আক্রমণ কম হবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন
রোগবালাই
পাউডারী মিলডিউঃ
পাতার উপরিভাগ সাদা পাউডার দিয়ে ভরে যায় এবং ফসল নষ্ট হয়।
রোগ প্রতিরোধী জাত চাষ করা উচিত। ২ মিঃলিঃ থিয়োভিট অথবা টিলট-২৫০ ইসি প্রতি ১ লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পোকামাকড় দমন
বিটলঃ
সাধারণতঃ বিটল কচি পাতা ও ডগা আক্রমণ করে এবং ঐ সব অংশ খেয়ে গাছ নষ্ট করে দেয়।
প্রতিদিন সকালে এ পোকা মেরে ফেলতে হবে। ১.১৫ লিটার ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি অথবা ফাইফানন ৫৭ ইসি ১০০০ লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল তোলা ও ফলন
ফসল তোলা
৪০-৪৫ দিন পর গাছে ফল ধরে। পর্যায়ক্রমে ফসল তোলা হয়। শসা সবুজ অবস্থায় সালাদের জন্য এবং পাকা অবস্থায় তরকারি বা মোরব্বার জন্য ব্যবহার করা হয়।
ফলন
শসার ফলন ৯-১৫ টন / হেঃ হতে পারে।
ফ্রেন্চবীন
পরিচিতি
বাংলা নামঃ
ফরাসি শিম (ফ্রেন্স বীন)
ইংরেজী নামঃ
French
bean
বৈজ্ঞানিক নামঃ
Phaseolus vulgaris
পরিবারঃ
Leguminosae
ফরাসি শিম একটি পুষ্টিকর সবজি। ইউরোপ ও আমেরিকায় এটি অতি জনপ্রিয়। ভিটামিন ‘এ’ এবং ‘সি’, আমিষ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। এ শিম কচি অবস্থায় খাওয়ার জন্য উপাদেয়। গাছ এক মিটারেরও ছোট হয় বলে মাচার দরকার হয় না।
জাত
বারি ঝাড় শিম-১ একটি উন্নত জাত। শিম ১৩-১৪ সেঃ মিঃ লম্বা ও ১ সেঃ মিঃ চওড়া হয়।
মাটি ও জমি তৈরি
মাটি
প্রায় সকল প্রকার মাটিতে এর চাষ ভাল হয়। তবে বেলে দো-আঁশ, দো-আশঁ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটিতে এটি সবচেয়ে ভাল হয়।
জমি তৈরি
বীজ বপনের জন্য ৪-৫টি চাষ ও মই দিয়ে ভালভাবে জমি তৈরি ও জমি আগাছা মুক্ত করতে হয়।
বীজ বপনের সময় ও এর হার
বীজ বপনের সময়
আশ্বিনের মাঝামঝি থেকে অগ্রাহায়নের শেষ (অক্টোবর-ডিসেম্বর) মাস পর্যন্ত বীজ বোনা যায়।
বীজের হার
একশতকে ৮০-১২০ গ্রাম, একরপ্রতি ৮-১২ কেজি ও হেক্টরপ্রতি ২০-৩০ কেজি হারে বীজ বপন করা হয়।
সারের পরিমান
|
সারের নাম |
প্রতি শতকে |
একরপ্রতি |
হেক্টরপ্রতি |
|
গোবর |
৪০ কেজি |
৪ টন |
১০ টন |
|
ইউরিয়া |
২০০ কেজি |
২০ কেজি |
৫০ কেজি |
|
টিএসপি |
৬০০ কেজি |
৬০ কেজি |
১৫০ কেজি |
|
এমপি |
৬০০ কেজি |
৬০ কেজি |
১৫০ কেজি |
সার ব্যবহারের নিয়ম
জমি তৈরির সময় গোবর মাটির সাথে ভাল করে মিশিয়ে দিতে হবে। সম্পূর্ন টিএসপি ও এমপি এবং অর্ধেক ইউরিয়া সারির একপাশে সারি থেকে ৭-৮ সেঃ মিঃ দূরে নালা করে ঐ নালায় প্রয়োগ করতে হবে। নালার গভীরতা বীজ লাগানোর সারির গভীরতা থেকে ২-৩ সেঃ মিঃ বেশি হওয়া উচিত। বাকী ইউরিয়া বীজ বোনার প্রায় এক মাস পর প্রথম নালার বিপরীত দিকের নালা করে প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ বপন ও বপনের দূরত্ব
বীজ বপন
প্রতি গর্তে ২-৩টি বীজ বুনতে হয়। চারা গজানোর ৭-৮ দিন পর প্রতি গর্তে একটি সুস্থ সবল চারা রাখতে হবে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে আগাছা তুলে মাটি আলগা করে দিতে হয় এবং রস কম থাকলে সেচ দিতে হয়।
বীজ বপনের দূরত্ব
৩০-৪০ সেঃ মিঃ দূরত্বে সারি করে ১০-১৫ সেঃ মিঃ দূরে দূরে সামান্য গর্ত করে বীজ লাগাতে হয়। মাটিতে রস থাকলে ৩-৪সেঃ মিঃ গভীরে এবং রস না থাকলে ৭-৮ সেঃমিঃ গভীরে বীজ লাগাতে হবে।
পরবর্তী পরিচর্যা
চারা ১৫ সে: মি: বড় হবার পর থেকে প্রতি ১৫ দিনে একবার তরল সার দিলে ভাল হয়। ফুলের কুড়ি দেখা দিলে এ সার দেওয়া বন্ধ করতে হবে। ৭ দিন অনত্মর অনত্মর সেচ ও প্রয়োজনে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হবে।
পোকা-মাকড়
জাব পোকা ডগায়, কুঁড়িতে ও ফুলের নিচে এস রস চুষে খায় ও আঠার মতো লেগে থাকে। ৫ লিটার পানিতে ১ চামচ রগর এল ৪০/ সুমিথিয়ন-৫০ মিশিয়ে ছিটাতে হবে।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
ফসল সংগ্রহ
বীজ বুনার এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই সীম ধরা শুরু করে এবং প্রায় ২ মাস সীম খাওয়া যায়। সীম দেখতে বরবটির মতো, লম্বায় প্রায় ১৫-২০সে: মি: হয়। প্রথম ফুল ফোটার ৮-১০ দিন পর শিম তোলার উপযুক্ত হয়।
ফলন
প্রতি শতকে ৪০-৫০ কেজি, একরপ্রতি ৪-৫ টন, হেক্টরপ্রতি ১০-১২ টন।
মটরশুটি
পরিচিতি
ইংরেজী নামঃ Pea / Green pea/ Garden pea
বৈজ্ঞানিক নামঃ Pisum sativum
পরিবারঃ Fabaceae / Leguminosae
Sub family: Papillionasae
বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে মটরশুটির চাষ হয়। আমিষ সমৃদ্ধ এ সবজির সিদ্ধ করা সবুজ শুটি বিকেলের নাস্তায় বেশ জনপ্রিয়। আজকাল পারিবারিক অনুষ্ঠানের বিশেষ রান্নার আয়োজনে ও পরিপক্ক শুটি ডাল হিসেবে এদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষভাবে শহরাঞ্চলে এ সবজির জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাত
বাংলাদেশে আরকেল, বনভীল, গ্রীন ফিস্ট, আলাস্কা, স্নো ফ্লেক, সুগার স্ন্যপ নামের জাতগুলোর আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট বারি মটরশুটি-১,বারি
মটরশুটি-২ ও বারি মটরশুটি-৩ নামের ৩টি জাত অবমুক্ত করেছে।
বারি মটরশুটি-১
এ জাতের ফুলের রং সাদা এবং শুটি সবুজ। প্রতি শুটিতে ৪-৭টি বীজ থাকে। শুটি বেশ মিষ্টি। প্রতি গাছে ২০-২৫টি শুটি ধরে। পরিপক্ক শুকনাবীজ কুঁচকানো, রং বাদামি। বপনের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে সবুজ শুটি সংগ্রহ করা যায়। এ জাতটি পাউডারি ও ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ১০-১২ টন সবুজ শুটি পাওয়া যায়।
বারি মটরশুটি-২
শুটি হালকা সবুজ। আকৃতি কিছুটা চ্যাপ্টা। শুটির আকার ৮ x ২ সেমি। এ মটরশুটি বেশ নরম। অপরিপক্ক বীজসহ সবুজ সটরশুটি শীমের মত খাওয়া যায়। শুটি সালাদ হিসেবে বা সিদ্ধ করেও খাওয়া যায়। পরিপক্ক শুকনা বীজ গোলাকার ও সবুজ। বপনের ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে সবুজ শুটি সংগ্রহ করা যায়। এ জাতটি পাউডারি ও ডাউনি মিলডিউ রোগ প্রতিরোধী। উন্নত পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ১২-১৪ টন সবুজ শুটি পাওয়া যায়।
জলবায়ু ও মাটি
মটরশুটি শীত প্রধান ও আংশিক আর্দ্র জলবায়ুর উপযোগী ফসল। ১২০-১৮০ সে. তাপমাত্রায় এটি সবচেয়ে ভালো হয়। মটরশুটির জন্য দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। মাটি অবশ্যই সুনিষ্কাশিত হতে হবে।
জমি তৈরি ও বীজ বপন
জমি তৈরি ও বীজ বপন
জমি খুব ভালো ভাবে তৈরি করতে হবে এর জন্য ৪/৫টি চাষ ও মই দিতে হবে। জমিতে ৪০সেমি দুরত্বে সারি করে ২০ সেমি পর পর বীজ রোপণ করতে হবে। জলাবদ্ধতার সম্ভাবনা থাকলে সারিগুলো ১৫সেমি উঁচু ও ১.২ মিটার চওড়া বেডে স্থাপন করা শ্রেয়। দুই বেডের মাঝে ২০ সেমি প্রশস্ত নালা রাখতে হবে।
বীজের হার
জাত ও বপন পদ্ধতি অনুসারে হেক্টর প্রতি প্রায় ৬০-৭০ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়।
বপন সময়
বাংলাদেশে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত সময়ে মটর শুটির চাষ হয়। বীজ বোনা হয় সাধারণত নভেম্বর মাসে।
সার প্রয়োগ
মটরশুটির জমিতে প্রতি হেক্টরে নিম্ন বর্ণিত হারে সার প্রয়োগ করতে হয়।
|
সার |
মোট পরিমাণ (হেক্টর প্রতি) |
*শেষ চাষে জমি তৈরির সময় |
পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে |
|
বপনের ২০ দিন পর |
|||
|
গোবর |
৮-১০ টন |
সব |
-
|
|
ইউরিয়া |
৪৫-৬০ কেজি |
২২-৩০ কেজি |
২৩-৩০ কেজি |
|
টিএস পি |
১৪৮-১৬০ কেজি |
সব |
-
|
|
এম পি |
১১২-১১৮ কেজি |
৫৬-৫৯ কেজি |
৫৬-৫৯ কেজি |
*
শেষ চাষে সার প্রদানের অন্তত ১০ দিন পর বীজ বপন করতে হবে।
অন্তরবর্তীকালীন পরিচর্যা
ভালো ফসলের জন্য বাউনী দেয়া দরকার । সারি বরাবর খুটি পুঁতে সুতলি দিয়ে বাউনি দেয়া যায়। শুকনো মৌসুমে ২-১ বার সেচ দিলে ফলন ভালো হয়। ফল ধরলে অন্তত এক বার সেচ দেয়া বাঞ্ছনীয়। সারির মাঝে হালকা কোপ দিয়ে মাঝে মাঝে আগাছা নষ্ট করে ফেলতে হবে।
রোগবালাই ও পোকামাকড়
রোগবালাই
রোগবালাইয়ের মধ্যে ড্যাম্পিং অফ, রাষ্ট, অ্যানথ্রাকনোজ এবং পাউডারী মিলডিউ প্রধান। এ সব রোগ চারা অবস্থায় আক্রমণ করে। ডাইথেন এম-৪৫ (২ গ্রাম/লিটার) প্রয়োগ করে এ সব রোগ দমন করা যায়। সে সাথে প্রতি লিটার পানিতে রিডোমিল এম. জেড ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ক্ষেতে স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পোকামাকড়
কাটুই পোকা
এ পোকা চারার গোড়া কেটে ফেলে ফসলের ক্ষতি করে। প্রাথমিক অবস্থায় ভোর বেলায় কেটে ফেলা চারার গোড়ার চারপাশ হতে পোকা খুঁজে মেরে ফেলে এর প্রকোপ কমানো যায়।
মাজরা পোকা
শুটির গায়ে ছিদ্র করে। এর দমনে ১০ লিটার পানিতে ৩৫ গ্রাম সেভিন মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়। আই পি এম অনুসরণে নিম তেল ২০০ মি লি ও ৫০ মি লি তরল সাবান একত্রে এক লিটার পানিতে মিশিয়ে সপ্তাহে দুই বার স্প্রে করে এ পোকা দমনে রাখা যায়।
ফসল সংগ্রহ ও ফলন
ফসল সংগ্রহ
মটর শুটির বীজ বোনার ৩০ থেকে ৪০ দিন পর আগাম জাতে ও ৫০-৬০ দিন পর নাবি জাতে ফুল আসে। ফুল আসার ২৫-৩০ দিন পর থেকেই অপক্ক শুটি সংগ্রহ করা শুরু করা যায়। শুটি তোলার পর ছায়া যুক্ত স্থানে ঝুড়িতে করে নিয়ে গিয়ে পরিবহন করতে হয়। ডাল হিসাবে সংরক্ষণ করতে হলে পাঁকা শুটি গুলি প্রথমে অল্প রোদে ও পরে ২-১ বার ভালো করে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে।
ফলন
ভালো জাতে বীজের ফলন হেক্টর প্রতি ১-৩ টন ও কাঁচা শুটির ফলনের পরিমাণ প্রায় ১০-১৪ টন।
মিষ্টি মরিচ (ক্যাপসিকাম)
ভুমিকা
পরিচিতি
বাংলা নামঃ মিষ্টি মরিচ
ইংরেজী নামঃ Capsicum
বৈজ্ঞানিক নামঃ Capsicum annum L.
পরিবারঃ Solanaceae
মিষ্টি মরিচ দক্ষিণ আমেরিকায় সম্ভবত ব্রাজিলে উৎপত্তি। ইহা গ্রীন পেপার বা বেল পেপার নামেও পরিচিত। জাতভেদে পাকা মরিচের রং লাল বা হলুদ হতে পারে। বাংলাদেশে ঝালবিহীন এই মরিচ সবজি হিসাবে তরকারীতে ও সালাদে ব্যবহৃত হয়। তবে বাংলাদেশে এর ব্যবহার ও চাষ খুব সীমিত।
পুষ্টিমান
প্রতি ১০০ গ্রাম (ভক্ষণযোগ্য) মরিচে ১.২৯ মি. গ্রাম প্রোটিন, ১১ মি. গ্রাম ক্যালসিয়াম, ১৮০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-এ, ১৭৫ মি.গ্রাম ভিটামিন-সি ও ০.৫৫ মি.গ্রাম নিয়াসিন আছে। অতএব ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য ভিটামিন থাকায় মানুষের জন্য পুষ্টিকর।
জলবায়ু ও মাটি
অতি শীত ও গরম এই মরিচের জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত, ১৬-২৫ সে. তাপমাত্রায় মরিচের ফলন ভাল হয়। রাতের তাপমাত্রা ১৫ সে. এর নীচে এবং দিনের তাপমাত্রা ৩২ সে. এর উপরে ও জমিতে রসের অভাব হলে ফুল ঝরে যায়, ফলন্ত গাছের ফল বৃদ্ধি ব্যহত হয়। দিনের দৈর্ঘ্যের উপর ফলনের কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। বাংলাদেশে শীত মৌসুমে দোঁ-আশ ও জৈব সার সমৃদ্ধ মাটি এ মরিচের চাষের জন্য উপযুক্ত।
জাত
বারি মিষ্টি মরিচ ১
বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা কতৃক উদ্ভাবিত জাত। ২০০৯ সালে এই জাতটি অবমুক্তায়িত হয়েছে। উজ্বল সবুজ বর্ণের বেল বা ঘন্টা আকৃতির। পাকলে এটা লাল বর্ণের হয়। গাছ প্রতি ৭/৮ টা ফল হয়। ফলের গড় ওজন ৭৫-৮৫ গ্রাম। ফলের দৈর্ঘ্য ৮-৯ সে.মি. ব্যাস ৭-৮ সে.মি.। ফলন ১৪-১৬ টন/হেঃ। বাংলাদেশের সর্বত্রই মধ্যম থেকে উচু জমিতে চাষ করা যায়।
বিদেশী কয়েকটি সংকর জাতের (এফ-১ হাইব্রিড) তথ্য নিম্নে দেওয়া হলোঃ
ক) সুপার সেট (সাকাতা বীজ কোঃ)
আগাম
জাত। গাছ ৫০-৬০ সে. মি
লম্বা। মরিচের ত্বক মোটা, কাঁচা অবস্থায় চকচকে সবুজ এবং পাকলে লাল হয়। ফলের আকার ১০ ১১ সে.মি.।
খ) ৯০-এফ-৪ (সাকাতা বীজ কোঃ)
আগাম
জাত। গাছ ৭০-৮০ সে.মি. লম্বা হয়। মরিচ লম্বায় ৮ সে. মি. ও ব্যাসে ১২ সে. মি.। কাঁচা মরিচ সবুজ ও পাকলে আকর্ষণীয় লাল হয়। ওজন ২০০ গ্রামের উপরে।
গ) ওয়ান্ডার বেল (তাকী বীজ কোঃ)
উচ্চ
ফলনশীল জাত। গাছ মাঝারী (৫০-৬০সে.মি.)। মরিচ গাঢ় সবুজ, পাকলে লাল, ত্বক মোটা, গড়ে ১২০ গ্রাম।
ঘ) জাম্বো সুইট (তাকী বীজ কোঃ)
গাছ
লম্বায় ৭০ মে. মি. এর
উপরে হয়। উচ্চ ফলনশীল আশু জাত। মরিচ লম্বায় (১৮ সে. মি.) ত্বক পুরু। কাঁচা মরিচ গাঢ় সবুজ ও পাকা অবস্থায় লাল, গড়ে ১৮০ গ্রাম।
ঙ) সিন্দুরী (নামধারী কোঃ)
কাঁচা অবস্থায় সবুজ ও পেকে লাল হয়। ত্বক মোটা ও চকচকে। মরিচের ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম। উচ্চ ফলনশীল জাত ও ৬৫ দিনের মধ্যেই ফসল সংগ্রহ করা যায়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সংকর জাত পাওয়া যায়। অতএব জাতের বৈশিষ্ট জেনে জাত নির্বাচন করতে হবে।
উৎপাদন পদ্ধতি
চারা উৎপাদন ও বপন পদ্ধতি
প্রতি বিঘায় (৩৩ শতাংশ) জমির জন্য ৩৫ গ্রাম বীজ প্রয়োজন। প্রতিটি বীজতলায় (৩ মিটার লম্বা, ১ মিটার চওড়া ও ৩০ সে.মি. উচু), ১০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে। বীজতলা থেকে ৩/৪ পাতা বিশিষ্ট চারা পলিথিন ব্যাগে (৩ ভাগ মাটি, ১ ভাগ পঁচা গোবর, ১ ভাগ বালু) স্থানান্তরিত করতে হবে। চারার বয়স ৪০-৪৫ দিন হলে মূল জমিতে লাগানোর উপযুক্ত হয়।
জমি তৈরী ও চারা রোপণ পদ্ধতি
সেচ
ও পানি নিষ্কাশন সুবিধা সহ উচু দোঁ-আশ জমি ৪-৫ বার চাষ ও মই দিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। পরবর্তীতে জমি অনুযায়ী দৈর্ঘ্য, ১.৫ মিটার প্রস্থ, ২৫ সে. মি. উচু বেডে চারা লাগাতে হবে। সারি থেকে সারি ও চারা থেকে চারার দূরত্ব উভয় ক্ষেত্রে ৫০ সে. মি. হবে। দুই বেডের মাঝে ৪৫ সে. মি. নালা
রাখা উচিত। চারা কার্তিক মাসের (১৫ অক্টোবর-১৪ নভেম্বরের) মধ্যেই রোপণ করতে হবে এবং রোপণের পর পরই হাল্কা সেচ দিতে হয়।
সারের পরিমাণ ও প্রয়োগ (বিঘা প্রতি)
|
সারের নাম |
পরিমান (কেজি) |
|
গোবর |
১২০০ |
|
ইউরিয়া |
৩০ |
|
টিএসপি |
৪৫ |
|
এমপি |
২৭ |
|
জিপসাম |
১৫ |
প্রয়োগের সময় ও পদ্ধতি
অর্ধেক গোবর জমি তৈরীর সময় দিতে হবে। বাকী অর্ধেক গোবর ও সবটুকু টিএসপি, ১/৩ অংশ ইউরিয়া ও এমপি এবং সবটুকু জিপসাম চারার জন্য নির্ধারিত বেডে মিশিয়ে দিতে হবে। অবশিষ্ট ইউরিয়া ও এমপি দুই কিস্তিতে যথাক্রমে চারা রোপণের তিন ও চার সপ্তাহ পর গাছের গোড়ার চারিদিকে প্রয়োগ করতে হবে।
পরবর্তী পরিচর্যা
মাটি আলগা, আগাছা বাছাই, শুকনা মরা পাতা পরিষ্কার করা সহ মাঝে মাঝে চারার গোড়ায় মাটি দিতে হবে। এছাড়া জমিতে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে। শুকনা খড়/ঘাস বা পলিথিন দিয়ে আচ্ছাদন দিলে জমিতে রসের অভাব হবে না। জলাবদ্ধতা যাতে না হয় সে দিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন এবং পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। অকালে ফল ধরলে সেগুলো ফেলে দিতে হবে।
পোকা ও রোগ দমন পদ্ধতি
|
পোকা/রোগের নাম |
ক্ষতির ধরণ |
প্রতিকার |
|
জাব পোকা |
পাতার রস চুষে খায়। পাতার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত করে। ভাইরাস রোগ ছড়ায়। |
আগাছা দমন। নেট বা মশারী দ্বারা জমি ঢেকে দেওয়া, এডমায়ার ২০০ এস এল ০.৫ এম. এল/লিটার অথবা যিথিয়ন-৫৭ ইসি ২ এম,এল/লিটার অথবা লিমিথিয়ন ২ মিলি/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
|
ত্রিপস |
আক্রান্ত পাতা উপরের দিকে শুকিয়ে যায় এবং আক্রান্ত স্থানে মরিচা দাগ পড়ে। |
ঐ |
|
মাকড়শা |
গাছের ডগা তামাটে হয়, পাতা নীচের দিকে কুকড়িয়ে যায়, আক্রান্ত ফলের ত্বক খসখসে হয়। |
অমিট/ভার্টিম্যাক/সালফোটারক্স/এনিমাইট ২ (দুই) গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার দিকে স্প্রে করতে হবে। |
|
এ্যানথ্রাক্সনোজ বা ঝলসানো রোগ |
আক্রান্ত ফলে বাদামী কালো রং এর দাগ পড়ে ও পচে যায়। |
বেভিষ্টিন বা নোইন ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
|
ফাইটোপথোরা ব্লাইট |
আক্রান্ত পাতা, কান্ড ও ফল ঝলসে যায়। |
রিডোমিল গোল্ড ২ গ্রাম/লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। |
|
ভাইরাস (কিউকামবর/মটেল ভাইরাস) |
পাতা হাল্কা সবুজ ছোট ও কুকড়ে যায়। গাছ খর্বাকৃতির হয়, ফুল ও ফল ধারণ ব্যহত হয়। |
আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলতে হবে। রোগবাহী পোকা (যেমন জাব পোকা /সাদা মাছি পোকা) কীটনাশক দিয়ে দমন করতে হবে। |
ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
কাঁচা ও পাকা অবস্থায় মরিচ সংগ্রহ করা যায়। মরিচ সংগ্রহের পর ছায়াতে ঠান্ডা ও শুষ্ক জায়গায় রাখতে হবে। ৯৫% আর্দ্রতা ও শুন্য সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মরিচ প্রায় ৪০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
ফলন
ফলন জাত ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর করে। প্রতি বিঘায় ১২০০-১৪০০ কেজি হতে
সজিনা
পরিচিতি
বাংলা নামঃ সজিনা
ইংরেজী নামঃ Drumstick
বৈজ্ঞানিক নামঃ Moringa
Sp
পরিবারঃ Moringaceae
সজিনা বাংলাদেশের অপ্রধান সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। সজিনা অত্যন্ত উপকারী ও পুষ্টিকর সবজি। সমগ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে দ্রুত বর্ধনশীল সজিনা গাছ মানুষের খাদ্য, পশুর খাদ্য, ঔষুধ, রঙ ও পানিশোধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটা খুব সহজেই বসতবাড়ীর আঙ্গিনায় এবং রাস্তার পাশে জন্মানো যায়। বাংলাদেশের আবহাওয়া সজিনা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এদেশে প্রধানত তিন ধরনের সজিনা পাওয়া যায়। Moringa
oleifera (শ্বেত সজিনা বা কৃষ্ণ গন্ধা), M.
stenopalata (রক্ত সজিনা বা মধুশিগ্রু) ও Moringa
pterigosperma (নীল সজিনা বা কৃষ্ণ সজিনা) নামে পরিচিত। তবে এদেশের মানুষের কাছে M.
oleifera-কে সজিনা ও M.
stenopalata- কে লাজনা বলে পরিচিত। সজিনার আদি নিবাস ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এটি হেজ (hedge) হিসেবে এবং বসতবাড়িতে সবজি হিসাবে ব্যবহারের জন্য রোপণ করা হয়।

সজিনা মাঝারি আকৃতির পত্রঝরা বৃক্ষ, ৭-১০ মিটার উঁচু হয়। এর বাকল ও কাঠ নরম। যৌগিক পত্রের পত্রাক্ষ ৪০-৫০ সেমি. লম্বা হয়, এতে ৬-৯ জোড়া ১-২ সেমি. লম্বা বিপরীতমুখী ডিম্বাকৃতি পত্রক থাকে। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে সজিনা গাছে ফুল আসে। মুকুলের ডাঁটাগুলো বিস্তৃত, গুচ্ছবদ্ধ ও ৫-৮ সেমি. লম্বা। মিষ্টি গন্ধে সবুজে আভাযুক্ত সাদা ফুল ২-৩ সেমি. ব্যাসের হয়। লম্বা সবুজ বা ধূসর বর্ণের সজিনা ফল গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। এক একটি ফল ৯টি শিরাযুক্ত ২২-৫০ সেমি. বা
কখনো কখনো এর বেশি লম্বা হয়।
সজিনা ও লাজনা এই দুই প্রকারই এদেশে চাষ করা হয়। তবে কৃষ্ণ সজিনা বনৌষধি হিসেবে খুব বেশি উপকারী কিন্তু এটি খুব বিরল। সজিনা অপুষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে, সজিনা ও লাজনা এদেশের লবণাক্ত এলাকা ছাড়া পাহাড়ি এলাকাসহ সারা বাংলাদেশেই অতি সহজেই জন্মানো সম্ভব।
পুষ্টিমূল্য ও ব্যবহার
সজিনা গাছের বিভিন্ন অংশ (কান্ড, বাকল, পাতা, ফুল, ফল ও বীজ) ঔষুধ, সুগন্ধি, তেল লুব্রিক্যান্ট হিসেবে এবং কসমেটিকস শিল্পে এর ব্যবহার সর্বজনস্বীকৃত। তবে সজিনার কাঠ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাতা, ফুল ও ফল তরকারী ও পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গাছের ছাল থেকে দড়ি তৈরি করা যায়। ঔষুধি বৃক্ষ হিসেবে সজিনা যথেষ্ট মূল্যবান। সজিনার পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে বিটা-ক্যারোটিন, প্রোটিন, ভিটামিন-সি ও আয়রন থাকে। এছাড়াও সজিনা গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে এন্টিসেপটিক বাতজ্বরের চিকিৎসা ও সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বীজচূর্ণ ব্যাকটেরিয়াজনিত চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সজিনার মূলের বাকল বায়ুনাশক, হজম বৃদ্ধিকারক, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, তলপেট ব্যথা, হিষ্টিরিয়া, হৃৎপিন্ড ও রক্তচলাচলের শক্তি বর্ধক হিসেবে কাজ করে। সজিনা ডাঁটার নির্যাস যকৃত ও প্লীহার অসুখে, ধনুষ্টংকার ও প্যারালাইসিস, কৃমিনাশক, জ্বরনাশক হিসেবে কাজ করে। সজিনা ডাটা ও ফুল ভাজা বা তরকারী করে খেলে জল ও গুটি এ দু’ধরনের বসন্তে আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে না। সজিনা ডাটাতে সোডিয়াম ক্লোরাইড নেই বললেই চলে। কাজেই এতে ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রিত থাকে। সজিনা ডাটায় ডায়েটরী ফাইবার থাকার কারণে নিয়মিত সজিনা ডাটা খেয়ে ব্লাডসুগার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সজিনা ডাটা রক্ত শূন্যতায়ও কাজ করে।
পুষ্টি উৎপাদন ও পরিমাণ (প্রতি ১০০ গ্রাম সজিনাতে)
|
পুষ্টি উৎপাদন |
সজিনা পাতা (পরিমাণ) |
সজিনা ডাঁটা (পরিমাণ) |
|
পানি |
৭৫% |
৮৭% |
|
প্রোটিন |
৬.৭ গ্রাম |
২.৫ গ্রাম |
|
কার্বোহাইড্রেট |
১৩.৪ গ্রাম |
৩.৭ গ্রাম |
|
চর্বি |
১.৭ গ্রাম |
০.১ গ্রাম |
|
ফাইবার |
০.৯ গ্রাম |
৪.৮ গ্রাম |
|
ক্যালরি |
৯০ কি. ক্যালরি |
২.৬ কি. ক্যালরি |
|
ক্যারোটিন |
১১৩০০ (ও.ট.) |
১৮০ (ও.ট.) |
|
থায়ামিন |
০.০৬ মি.গ্রাম |
০.০৫ মি.গ্রাম |
|
রিবোফ্লাভিন |
০.০৫ মি. গ্রাম |
০.০৭ মি. গ্রাম |
|
নায়াসিন |
০.৮ মি. গ্রাম |
০.২ মি.গ্রাম |
|
ভিটামিন-সি |
২২০ মি. গ্রাম |
১২০ মি. গ্রাম |
|
ক্যালসিয়াম |
৪৪০ মি.গ্রাম |
৩০ মি. গ্রাম |
|
আয়রণ |
৭.০ মি.গ্রাম |
৫.৩ মি.গ্রাম |
রাসায়নিক উপাদান
সজিনাতে বিভিন্ন রকম এ্যালকালয়েড যেমন মরিনজিনিন, মরিনজিন, কতিপয় এমরফাস বেসেস, এন্টিবায়োটিক টেরিগোস্পারমিন, গ্রাম-পজিটিভ, গ্রাম-নেগেটিভ এবং এসিড ফাষ্ট ব্যাক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিক হিসেবে টেরিগোস্পারমিন ব্যবহার করা হয়।
উৎপাদন পদ্ধতি
জলবায়ু ও মাটি
সজিনার জন্য সর্বদা শুষ্ক আবহাওয়া দরকার। পুষ্পায়ন ও ফল ধারণ উভয় সময়ে আকাশ কুয়াশামুক্ত, তুষারমুক্ত ও মেঘমুক্ত থাকা উচিৎ। অতিরিক্ত বায়ুমন্ডলীয় আর্দ্রতায় পোকা-মাকড় ও রোগের প্রাদুভার্ব বেশি হয়। সব ধরনের মাটিতেই সজিনা চাষ করা যায়। তবে সুনিষ্কাশিত, সামান্য অম্লীয়, উষ্ণ ও আর্দ্র পলিমাটি সজিনা চাষের জন্য সর্বোত্তম। যে কোন ধরনের মাটিতে এটি হলেও ৭৫০-২১২৫ মি. মি. বৃষ্টিপাত সজিনার জন্য উত্তম। ৫.৬-৭.৫ pH সম্পন্ন মাটিতে সজিনা ভালো জন্মে। এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তবে বন্যা কবলিত জায়গায় সজিনার চাষ করা উচিত নয়। জলাবদ্ধ মাটিতে গাছের বৃদ্ধি, ফুল ও ফল ধারণ ব্যাহত হয়।
বংশ বিস্তার
প্রতিটি লম্বা সজিনার ফলে ১০-১৫টি বীজ থাকে, এগুলো তিন শিরাবিশিষ্ট এবং ত্রিভুজাকৃতির। বীজ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব হলেও অঙ্গজ বা কাটিং (Cutting) থেকে নতুন চারা তৈরি করাই সহজ এবং উত্তম। বীজ থেকে চারা তৈরির ক্ষেত্রে গাছ থেকে পরিপক্ক সজিনা সংগ্রহ করে মে মাসে সজিনা ডাঁটা থেকে আলাদা করা হয়। সংগৃহীত বীজ হালকা রৌদ্রে শুকিয়ে বীজ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। জুন-জুলাই মাসে সীডবেড ভালোভাবে কুপিয়ে পঁচা গোবর দিয়ে বেড প্রস্তুত করা হয়। সীড বেডের আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করা যেতে পারে। তবে বেডের চতুর্দিকে ৩০-৫০ সেমি. আকারে ড্রেন রাখতে হবে। অতঃপর বীজ, বেডে ১০-১৫ সেমি. দূরে
দূরে লাইন করে বপন করতে হয়। ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। চারা গজানোর থেকে শুরু করে চারা উঠানো পর্যন্ত সীডবেড আগাছামুক্ত ও সেচ প্রদান করতে হবে। কীটপতঙ্গ ও রোগবালাই দমনের জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে বীজ থেকে তৈরি চারার ফল আসতে তিন-চার বছর সময় লাগে।
তবে কাটিং থেকে চারা তৈরি করাই উত্তম। এক্ষেত্রে অল্প যত্ন ও দ্রুত সজিনা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে বয়স্ক গাছ থেকে প্রুনিং এর সময় যে ডাল কেটে ফেলা হয় তা থেকে রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সতেজ ও স্বাস্থ্যবান শক্ত ডাল ২.৫-৩ ফুট (৭৫-৯০ সেমি.) লম্বা ও ৩-১৬ সেমি. ব্যাস বিশিষ্ট ডাল নির্বাচন করা উত্তম। প্রস্তুতকৃত কাটিং সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করা হয়। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস।

কাটিং রোপণ
বসতভিটার আশপাশে সজিনা কাটিং লাগানোর জন্য তেমন নিয়ম অনুসরণ করা হয় না, তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাগান করার ক্ষেত্রে ৪-৫ মিটার ৪-৫ মিটার দূরত্বে ষড়ভূজ পদ্ধতিতে রোপণ করা উত্তম। এক্ষেত্রে জমি ভালোভাবে চাষ করে ৫০-৭৫ সেমি. ৫০-৭৫ সেমি. ৫০-৭৫ সেমি. আকারের গর্ত করতে হবে। সজিনার কলম চারা রোপণের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর, ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টি.এস.পি. ও এম.পি. সার
১০০ গ্রাম করে এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে দিয়ে, গর্তের মাটি উপরে-নীচে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। সার দেয়ার ২০-৩০ দিন পরে গাছ লাগানো যাবে। এছাড়া রাসায়নিক সার না দিয়ে প্রতি গর্তে ৪০-৫০ কেজি পঁচা গোবর সার গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে উক্ত গর্তে সাথে সাথে গাছ লাগানো যায়। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে। কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির সাথে ৩/৪ টি নিম পাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন ৮৫ ডব্লিউপি গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিং এর মাথায় আলকাতরা দিয়ে দিতে হবে। এতে কাটিং এর মাথা শুকিয়ে যাবে না।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
গাছ লাগানোর পরের বছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর, ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টি.এস.পি. ও এম.পি. এবং
জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ৫০ গ্রাম করে সার দুপুর বেলায় সূর্যের আলো গাছের উপর পরলে, গাছ যে পরিমাণ জায়গায় ছায়া প্রদান করে, সেই পরিমাণ জায়গায় গাছের চতুর্দিকের মাটি কোদাল দিয়ে ভালোভাবে কুপিয়ে সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর প্রতি বছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০-৫০ কেজি পচা গোবর ঠিক রেখে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, টি.এস.পি. ও এম.ও.পি. সার
এবং জিপসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট সার ২০ গ্রাম করে বর্ধিত হারে প্রয়োগ করতে হবে। এই গাছ জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই বর্ষাকালে পানি নিকাশ ও খরা মৌসুমে সেচ প্রদান করা দরকার।
অন্যান্য পরিচর্যা
গাছের গোড়ায় সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা দরকার। গাছ লাগানোর সাথে সাথে খুঁটি দিয়ে (৪) চার এর মত ‘নট’ করে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনে জৈব-অজৈব বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের ভিতর মরা এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। সজিনা/লাজিনা’র ক্ষেত্রে প্রথম বছরে মাটি থেকে ১ মি. দুরত্ব রেখে উপরের অংশ কেটে ফেলা হয়। এই গাছ থেকে ৪-৫ মাসে নতুন কুশি বের হয় এবং নতুন কুশি থেকে ফল দেয়া শুরু করে। তবে কুশির সংখ্যা বেশি হলে ভালো আলো-বাতাস পাওয়ার জন্য কিছু ডাল কেটে বা ভেঙ্গে পাতলা করে দেয়া উচিত। সাধারণত ৩ বার ডাল কেটে দেয়া হয়, যা ৯ মাস, ১৭ মাস ও ২৫ মাস পর্যন্ত বয়সে করা হয়। তবে বসতবাড়িতে সজিনা গাছের ক্ষেত্রে তেমন কোন নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। এক্ষেত্রে প্রতি বছর সজিনা সংগ্রহের পর বিগত বছরে যে জায়গায় ডাল কাটা হয় তার পরে ৫০-৭৫ সেমি. রেখে ডাল কেটে দেওয়া হয়। প্রতি বছর ডাল কাটার পর কাটা অংশে আলকাতরা দেওয়া ভালো।
সংগ্রহ ও ফলন
শাখা কলম হতে প্রাপ্ত গাছ ১ বছর পরেই সজিনা দেয়া শুরু করে। সজিনা যখন কচি অবস্থা থেকে কিছু শক্ত হতে শুরু করে। তখন থেকে সজিনা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়। প্রথম ২ বছর সাধারণত ফলন কিছুটা কম হয় (৮০-৯০ টি সজিনা/গাছ/বছর)। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সজিনার পরিমাণও বাড়তে থাকে। একটি বয়স্ক গাছ (৪-৫ বছর) থেকে বছরে ৫০০-৬০০টি সজিনা পাওয়া যায়। সজিনা সাধারণত মার্চ-মে এর মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু লাজিনা সারা বছরই গাছে হয় সুতরাং সারা বছরই গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। লাজিনা এক বছরেই ফল দেয় এবং গাছ লাগানোর ৬ মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা সম্ভব। সজিনা গাছ থেকে ২-৩ মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায় এবং প্রজাতিভেদে প্রত্যেক গাছে ২৫০-৪০০ টি সজিনা পাওয়া যায়।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
সজিনার অর্থনৈতিক গুরুত্ব
বাংলাদেশে প্রতি কেজি সজিনার দাম প্রায় ২০-৫০ টাকা। পূর্ণবয়স্ক (৪-৫ বছর) একটি গাছে ২০-৬০ কেজি হিসেবে সজিনার উৎপাদন ধরলে প্রতি বছরে প্রতি গাছ থেকে আয় হয় প্রায় ৪০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকা। একজন চাষি তার বসতভিটায় ৫ টি গাছ লাগা্লে সহজেই এ থেকে প্রতি বছরে ২,০০০ টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকা আয় করতে পারেন। অধিকিন্তু সজিনার গাছের কাটা অংশ থেকে জ্বালানি কাঠ পাওয়া যায়। সুতরাং আমাদের দেশে সজিনার অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি বসতভিটায় একটি করে সজিনা গাছ লাগালে প্রায় ২,০০০ কোটি থেকে ১৫,০০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব, যা আমাদের পুষ্টি উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সজিনার উৎপাদন ও ব্যবহার দিন দিন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিধায় বর্তমানে সজিনা প্রধান সবজি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ সবজির উৎপাদন, ফলন ও জাত উন্নয়নে আমাদের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খাদ্য চাহিদা। কিন্তু আমাদের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাই আবাদযোগ্য পতিত জমিকে আবাদের আওতায় আনতে হবে। বাড়ির আঙ্গিনা, স্কুলের পার্শ্বে, রাস্তার পাশে, বনাঞ্চলের ফাঁকা জায়গায়, পাহাড়ি এলাকায়, চরাঞ্চলের অনেক পতিত জমিকে চাষের আওতায় এনে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা অনেক খানি পূরণ করা যায়। অন্যদিকে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতিও অনেকাংশে দূর করা যায়। মানব শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য অন্যান্য খাদ্যের সাথে সবজি উৎপাদন ও মাথাপিছু ভক্ষণমাত্রা দুই-ই প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। এজন্য স্বাস সচেতনতার অভাব যেমন দায়ী তেমনি দায়ী সবজির অপ্রতুল উৎপাদন, এর প্রাপ্যতা ও বাজার মূল্য। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে শরীর সুস্থ, সবল ও কর্মঠ রাখার জন্য একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২০০-২২০ গ্রাম শাকসবজি খায় তার পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৭০ গ্রাম (আলু, মিষ্টি আলুসহ)। যদি আলু ও মিষ্টি আলুকে বাদ দেয়া যায় তাহলে সবজি ভক্ষণের পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ৩০ গ্রাম। এক্ষেত্রে ভারত ৯০-৯৫ গ্রাম, থাইল্যান্ড ২৫০-২৭০ গ্রাম, চীন ২৯০-৩০০ গ্রাম ও জাপান ৪৩০-৪৪০ গ্রাম শাকসবজি খায়। উল্লেখ্য যে, শরীরের চাহিদার শতকরা ২০-৩০ ভাগ ভিটামিন-বি, ৯০-৯৫ ভাগ ভিটামিন-সি, ৬০-৮০ ভাগ ভিটামিন-এ শাকসবজি ও ফলমূল থেকে আসে। এছাড়াও শাকসবজিতে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। এদেশের মানুষ ভিটামিন-এ এর অভাবে ৮৮%, ভিটামিন-সি এর অভাবে ৮৭%, ভিটামিন-বি এর অভাবে ৯৬%, এবং ক্যালসিয়ামের অভাবে ৯৩% প্রতিনিয়ত ভুগছে। এ সমস্যার সমাধানে একমাত্র উপযুক্ত দাওয়াই হলো প্রতিদিনের সতেজ রকমারী শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া। এ প্রেক্ষাপটে সবজি উৎপাদন বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় এর বিকল্প নেই। এতে সজিনার উৎপাদন বাড়িয়ে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য গবেষণা ও সমপ্রসারণ কার্যক্রমের ওপর জোড় দেয়ার সময় এসেছে। এতে করে সজিনার বাণিজ্যিক উৎপাদন, দেশের চাহিদা পূরণ, বিদেশে রপ্তানি বহুমুখীকরণে কৃষকের আগ্রহ ও বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।
রাজশাহী জেলায় চারঘাট ও বাঘ, যশোর, নাটোর ও নীলফামারী জেলায় কিছু কিছু কৃষক বাণিজ্যিকভাবে সজিনা উৎপাদন করে। তবে এছাড়া বসতভিটায় ও রাস্তার পাশে ২-১টি সজিনার গাছ জন্মাতে দেখা যায়। গর্ভবতী ও দুগ্ধ দানকারী মায়ের অপুষ্টি দূরীকরণে ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে সজিনার সম্ভাবনার কথা বিবেচনা করে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, ইনফ্যান্ট অ্যান্ড ইয়াং চাইল্ড (IYCF) প্রজেক্টের আওতায় ময়মনসিংহ জেলার ধোবাউড়া ও হালুয়াঘাট উপজেলা, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী ও শ্রীবর্দী উপজেলা এবং নেত্রকোনা জেলার দূর্গাপুর উপজেলার বসতভিটায় সজিনার চারা গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের সজিনার কাটিং বিতরণ ও সজিনার উৎপাদন কলাকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সজিনার উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। যা একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
রোগ ও পোকামাকড়
পোকা
সাধারণত সজিনা গাছের কান্ডে ও পাতায় বিছা পোকা এবং ফলে মাছি পোকার আক্রমণ দেখা যায়। বিছা পোকার ডিম পাতায় দেখা দিলে বা বিছা পোকার লার্ভা সজিনা গাছের কান্ডে বা পাতায় দেখা দিলে তা সংগ্রহ করে মেরে ফেলতে হবে। বিছা পোকা চেনা খুবই সহজ কারণ এরা কান্ডে বা পাতায় গুচ্ছাকারে থাকে। শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়ায় সজিনা গাছ মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। যার ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়। এছাড়া উঁইপোকা, এফিড/জাবপোকা, লিফ মাইনর ও হোয়াইট ফ্লাই এর আক্রমণ দেখা যায়। এ জন্য যে কোন কীটনাশক যেমন-সুমিথিয়ন/ডেসিস/সিমবুশ/ম্যালাথিয়ন/নিমবিসিডিন এর যে কোনটি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ২৫ মিলি. মিশিয়ে স্প্রে করে উক্ত পোকাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
রোগ
সজিনা গাছের খুব একটা রোগবালাই দেখা যায় না। তবে ফল পচা রোগ, শিকড় পচা রোগ, বাকল পচা রোগ পরিলক্ষিত হয়। জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পঁচা রোগের আক্রমণ বেশি হয়। এতে গাছ নেতিয়ে পড়ে, ফলে পাতা হলুদ হয়ে যায়। উপরোক্ত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কোন ছত্রাকনাশক যেমন-ব্যাভিষ্টিন, থিওভিট, বোর্দো মিশ্রণ (তুঁতে : চুন : পানি = ১ : ১ : ১০০), ডায়থেন-এম ৪৫, রিডোমিল গোল্ড ইত্যাদির যে কোন একটি ১০ লিটার পানিতে ৪০-৪৫ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করে এ রোগগুলো সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।