পরিচিতি
বাংলা নামঃ চা
ইংরেজী নামঃ
Tea
বৈজ্ঞানিক নামঃ Thea sinensis / Camellia thealink
পরিবারঃ
Theaceae
আমাদের দেশে চা বর্তমানে একটি অন্যতম নেশা জাতীয় ফসল। চা চিরহরিৎ গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। চায়ের কচি পাতা ও কুড়ি তুলে নানাভাবে শুকিয়ে ব্যবহার করা হয়। বাণিজ্যিক চা সবুজ বা কালো হয়।
পাটের পর চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল। বছরে গড়ে ৩০-৩৫ মিলিয়ন কেজি চা রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রতি বছর ১৬০-১৬৫ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি বছর ৫০০০০ হেক্টর জমিতে চা এর চাষ হয় এবং এর উৎপাদন প্রায় ৬০০০০ কেজি।
চা পানীয় হিসাবে ব্যবহার ছাড়াও এটি হতে ট্যানিন সংগ্রহ করে রং শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যবহৃত চা পাতা উত্তম জৈব সার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
উৎপত্তি ও বিস্তৃতি
চা-এর আদি নিবাস ভারতবর্ষ। এশিয়া মহাদেশে ভারত, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে প্রচুর চা উৎপন্ন হয়। ব্রাজিল, আর্র্জেন্টিনা এবং পেরুতেও চা-এর আবাদ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে সিলেট জেলাকেই চায়ের উৎপাদনের এলাকা বলা যায়। এ জেলায় মোট ১৩০টি চায়ের বাগান আছে। অতঃপর চট্টগ্রামে ২০ টি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১টি ও কুমিল্লায় একটি চা বাগান আছে। এ সমস্ত বাগানের জন্য জমি রয়েছে ৪৩২০৯ হেক্টর। ইদানিং চা চাষের জমির পরিমান কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জরিপে দেখা যায় ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে চা চাষাধীন জমির পরিমান প্রায় ৪৮১৭৮ হেক্টর।
জাত
চা বিজ্ঞাণীগণ বিভিন্নভাবে অংগজ বংশবিস্তারের মাধ্যমে কয়েকটি ভাল জাতের চারার উদ্ভাবন করেছেন। জাতগুলো হচ্ছেঃ-
বি. টি. - ১
(BT1), বি.
টি. - ২
(BT2), বি.
টি. - ৩
(BT3), টি.
ভি. - ১ (TV1)
ভারত থেকে সংগ্রহ। এছাড়াও শ্রীমঙ্গল চা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীগণ বি-১২ (B -12) নামে আরও একটি চায়ের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেন। এ জাতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি সুঘ্রাণযুক্ত এবং ফলন অন্যান্য জাতের তুলনায় অনেক বেশি।
জলবায়ু ও ভূমির উচ্চতা
২০ - ৩০ সেঃ তাপমাত্রায় চা ভাল জন্মে। সর্বাধিক উত্তম তাপমাত্রা ২৩-২৮ সেঃ এবং সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ১৯-২০ সেঃ । গাছ ৪ সেঃ তাপমাত্রায়ও বাচঁতে পারে। ১৫ সেঃ তাপমাত্রার নিচে চায়ের দৈহিক বৃদ্ধি খুব কমে যায়। ৩৮ সেঃ এর বেশি তাপমাত্রা চা উৎপাদনের জন্যে ভাল নয়। বাৎসরিক ১৭৫-২০০ সেঃমিঃ বৃষ্টিপাতে চা ভাল জন্মে। কিন্তু ৫০০-৬৫০ সেঃমিঃ বৃষ্টিপাতেও চা জন্মাতে পারে বর্ষা ঋতুতে অত্যধিক আর্দ্রতা থাকা প্রয়োজন। সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ৬০০-১২২০ মিঃ পর্যন্ত উঁচু জমিতে চা জন্মে।
মাটি
হালকা অম্লাত্বক জমি চা-এর জন্যে উপযোগী। পলি-দোআঁশ থেকে বেলে-দোআঁশ মাটিতে চা ভাল জন্মে। পলি নিষ্কশিত ঢালু জমিতে চা ভাল জন্মে। মাটির অম্লতা ৪.৫- ৫.৮ পিএইচ পর্যন্ত হতে পারে।
চায়ের ছায়াবৃক্ষ
প্রখর সূর্যতাপ এবং ঝড় বৃষ্টির ঝাপটা হতে চা গাছকে রক্ষা করার জন্যে বাগানের ভেতরে কিছু স্থায়ী গাছ লাগাতে হয়। এ সমস্ত গাছগুলো ছায়াবৃক্ষ নামে পরিচিত। বৃক্ষগুলো শিম্বী পরিবারযুক্ত হলে এরা মাটিতে জৈব পদার্থ ও সরবরাহ করতে পারে। এ দেশের বাগানে সচরাচর দৃষ্ট বৃক্ষগুলো হচ্ছেঃ-
(ক) করই
(খ) চাম করই
(গ) কালা শিরীষ
(ঘ) লোহা শিরীষ ইত্যাদি
১-১.৫ বছর বয়সের চারা চা বাগানে ছায়া বৃক্ষ হিসেবে ১৩ x ১৩ মিটার দূরত্বে লাগানো হয়। বাংলাদেশের চা-বাগানে স্বল্প স্থায়ী ছায়া বৃক্ষও লাগানো হয়ে থাকে। যেমন- বগামেডুলা ও অড়হর জাতীয় গাছ প্রথম পর্যায়ে চারা চা-গাছে ছায়া দান করে।
বংশবিস্তার
যদিও লেয়ারিং পদ্ধতিতে চা বাগানে বংশবিস্তার করা যায়। তবে সাধারণত বীজ দিয়ে চা এর বংশবিসত্মার করা হয়। গাছ হতে সংগৃহীত অল্পদিনের ও বড় আকারের বীজ ব্যবহার করতে হয়। কেননা অনেক দিনের গুদামজাত করা চা বীজ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ভাল মানের ও অধিক ফলন পাওয়ার জন্য অঙ্গজ বংশবিস্তার (জোড়কলম, চোখকলম, দাবাকলম প্রভৃতি) করাই লাভজনক।
চারাগাছ জন্মানো
চা বাগানের আশপাশেই বীজতলার জন্য জমি নির্বাচন করতে হয়। জমির মাটি খুব ভালভাবে ঝুরঝুরা ও নরম করে এবং আগাছা পরিষ্কার করে বীজতলা প্রস্তুত করতে হয়। বীজতলায় ফাটলযুক্ত বীজ বপন করতে হয়। প্রতি হেক্টরে ১৩-১৪ মেট্রিক টন বীজের প্রয়োজন হয়।
বীজ সরাসরি বপন না করে চারিদিকে বেড়া দেয়া অন্ধকার ঘরে বালির স্তরে প্রথমে বপন করতে হয়। ১০-১২ দিন পর পানি সিক্ত বালুতে রাখা বীজ ফেটে ওঠে। বীজের ফাটল দিকটা উপুড় করে ২০ x ২০ সেঃমিঃ দূরে দূরে বীজ আবার বপন করতে হয় এবং মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। বীজতলায় চারাগুলো ১-১.৫ বছর পর্যন্ত রাখা হয় ৭/৮ মাস বয়সের চারার আগা ভেঙ্গে দেয়া হয়।
বীজতলায় N.P.K -এ তিন জাতীয় সার ( ১ : ১ : ১ অনুপাতে মিশ্রিত) ২৭/২৮ কেজি প্রতি হেক্টরে ৮-১২ বারে প্রয়োগ করা হয়।
জমি তৈরি
জমি তৈরির পূর্বেই বাগানে ছায়াবৃক্ষ রোপণ করা হয়। ৫/৬ টি চাষ ও উল্টা চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করা হয়। আগাছা এবং আবর্জনা জমি থেকে সরানো হয়।
রোপণের সময় ও দূরত্ব
রোপণের সময়
বাগানে চা মে-জুন মাসে লাগাতে হয়, তবে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চারা লাগানো যেতে পারে।
চারা থেকে চারার দূরত্ব
পূর্ব থেকেই প্রস্তুত বাগানে নির্দিষ্ট মাপের দূরত্বে গর্ত অথবা পিট তৈরি করা হয়। পাহাড়ের টিলার চারাগাছ কিছু ঘন ও সমতল জায়গায় কিছুটা পাতলা করে লাগাতে হয়।
নিন্মে চা-এর জাতভেদে বাগানের (টিলা
ও সমতলে) চারা লাগানোর দূরত্ব দেওয়া হলঃ-
|
জাতের নাম |
টিলায় রোপণ |
সমতলে রোপণ |
|
বি.টি.-
১ (BT1) |
১.২ মিঃ
x ৭৬ সেঃমিঃ |
১.৫ মিঃ x ৬০ সেঃমিঃ |
|
বি.টি.-
২ (BT2) |
১.২ মিঃ
x ৭৬ সেঃমিঃ |
১.৫ মিঃ x ৬০ সেঃমিঃ |
|
বি.টি.-
৩ (BT3) |
১.২ মিঃ
x ৬১ সেঃমিঃ |
১.৫ মিঃ x ৬০ সেঃমিঃ |
|
টি.ভি
- ১ (TV1) |
১.২ মিঃ
x ৬১ সেঃমিঃ |
১.৫ মিঃ x ৬০ সেঃমিঃ |
রোপণের পদ্ধতি
জাতভেদে নির্দিষ্ট দূরত্বে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে বাগানে চারা রোপণ করা যায়ঃ
(১) ত্রিভুজাকার পদ্ধতি
(২) বর্গক্ষেত্রাকার পদ্ধতি
(৩) আয়তক্ষেত্রাকার পদ্ধতি বা এক লাইন পদ্ধতি
(৪) জোর লাইন পদ্ধতি
(৫) তিন লাইন পদ্ধতি
সার প্রয়োগ
চা গাছ চির সবুজ এবং পাতাই ফসল হিসাবে গন্য হয় বলে এ ফসলের জন্যে সার অতীব প্রয়োজনীয়। তবে ফসফরাস ও পটাশ সার ব্যবহার করা হয়। অল্পবয়সী চা গাছের জন্যে হেক্টর প্রতি ১৮ থেকে ৩৬ কেজি নাইট্রোজেন ব্যবহার করতে হয়।
যেহেতু চা গাছ অম্লীয় মাটিতে ভাল জন্মে তাই ইউরিয়ার পরিবর্তে অ্যামোনিয়াম সালফেট ব্যবহার করা হয়। টি.এস.পি ও এম.পি সার যথাক্রমে ফসফরাস ও পটাশ সরবরাহ করে। গাছ ছাটাই করার পরে কুঁড়ি ধরাকালীন সময়ে ২২৫-৩০০ কেজি অ্যামোনিয়াম সালফেট প্রয়োগ করা হয়।
পরিচর্যা
ছাঁটাইকরণ একটা গুরুত্বপূর্ন কাজ যা দ্বারা গাছকে একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় রাখা হয়, যা গাছের অঙ্গজ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পাতা আহরণের জন্যে চা গাছকে একটা প্রয়োজনীয় উচ্চতা ও নতুন পাতা গজানোর জন্যে রোপণের সাড়ে ৩ বছর পর থেকে ছাঁটাই কাজ শুরু হয়। এর ফলে নতুন শাখাও বের হয়। প্রতি বছরই হালকা ছাঁটাই করা হয়। প্রথম ছাঁটাইকরণে গাছকে ৩০ সেঃমিঃ উপরে কাটা হয়। ৫/৬ বছর ধরে প্রতি ঋতুর শেষে ১০ সেঃমিঃ করে ছাঁটাই করা হয়। এভাবে ছাঁটাই করতে করতে চা গাছের উচ্চতা ১.২ মিটার হলে একজন শ্রমিক দাঁড়িয়ে পাতা সংগ্রহ করতে পারেন। তখন চা গাছকে বেশ নিচু থেকে ছাটাই করে পাতা তোলা উচ্চতায় নামানো হয়। ২৫/৩০ বছর পরে সমস্ত গাছকে মাটি থেকে তুলে পুনরায় চারা লাগানো হয়।
রোগ ও কীট দমন
চা বাগানে নানা রকম পোকামাকড় ও রোগের আক্রমণ দেখা যায়। যথা সময়ে এদের দমন করা উচিত।
পোকার মধ্যে লাল মাকড়সা, চা পাতার মশক পোকা, উইপোকা এবং রোগের মধ্যে রেড ব্লাস্ট, ব্লাক রট এবং ভায়োলেট রট উল্লেখযোগ্য।
লাল মাকড়সা সারা বছর চায়ের কচি পাতা ও কুঁড়ি খায়, আক্রান্ত পাতাগুলো লাল হয়ে যায়। গাছ ছাঁটাইয়ের পর বাকিগুলো ঝাড়িয়ে দিলে লাল মাকড়সনা দূরীভূত হয়।
মশক পোকা চায়ের কচি পাতা ও কুঁড়ির রস চুষে খায়। প্রতি হেক্টরে দেড় কেজি ডি.ডি.টি ৪৫০ লিটার পানিতে মিশিয়ে সন্ধ্যাবেলা ও খুব ভোরে প্রয়োগ করলে মশার আক্রমন দমন করা যায়।
উইপোকা ডাল-পালার উপরে মাটির প্রলেপ দিয়ে উপর হতে নিচের দিকে যেতে থাকে। আক্রান্ত ডালে পাতা বা কুঁড়ি হয় না। প্রতি হেক্টরে ৪.৫ লিটার ডায়েলড্রিন প্রয়োগ করলে এ পোকা দমন করা যায়।
রেড ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত গাছ কমলা রঙের মহ দেখায়। তামা মিশ্রিত ঔষধ প্রতি হেক্টরের জন্যে ২০ লিটার ৪৫০ লিটার পানির সাথে মিশায়ে ১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রয়োগ করতে হয়। যেহেতু বগা মেডুলা গাছ হতে এ রোগ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয়। সেহেতু বগা মেডুলা গাছ বাগান থেকে তুলে ফেলা প্রয়োজন।
ব্ল্যাক রট রোগে আক্রান্ত গাছের পাতা সূর্যালোকে ঝলসানো দাগ পড়ার মত দেখায়, পরিশেষে পাতা পড়তে থাকে বা পাতা গাছের গায়ে ঝুলিতে থাকে। এপ্রিল-মে মাসের মধ্যবর্তী সময়ে তামা মিশ্রিত ঔষধ ১৫ দিন অন্তর প্রয়োগ করতে হয়।
ভায়োলেট রুট রট চা বাগানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে দেখা যায়। আক্রান্ত শিকড় থেকে এক রকম উগ্র টকযুক্ত গন্ধ বের হয়। আক্রান্ত স্থান গোলাপী থেকে কালো রং ধারন করে। এজন্য চা বাগানে যাতে পানি জমতে না পারে সে দিকে নজর রাখতে হয়।
কুঁড়ি ও পাতা আহরণ
এটি এমন এক ধরনের কাজ যেখানে কয়েকদিন পর পর চা গাছের কচি পাতা ও কুঁড়ি গাছের উপরের অংশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। রোপণের ৩ বছর পর থেকে পাতা আহরণ করা যায়। দুটি কচি পাতা ও একটি কুঁড়ি সাধারণত সংগ্রহ করা হয়। ছাঁটাইকরণ সময়ের প্লানিং নির্ভর করে সাধারণত বছরে ১৫/১৬ বার পাতা ও কুঁড়ি সংগ্রহ করা যায়।
৬০% চা, জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বও মাসে আহরন করা যায়।
২০% চা, জুন ও নভেম্বর মাসে আহরন করা হয়।
২০% চা, জুন, নভেম্বর মাস ছাড়া বছরের অন্যান্য সময়ে আহরন করা হয়।
ফলন
চায়ের ফলন ১৭০০-৩৫০০ কেজি/হেক্টর হয়ে থাকে।