বেগুনের পরিচিতি

বাংলা নামঃ বেগুন
ইংরেজী নামঃ Brinjal / Egg plant
বৈজ্ঞানিক নামঃ Solanum melongena
পরিবারঃ Solanaceae

 


বেগুন বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচলিত সবজি আলুর পরে এর স্থান। সারা বছর এটি বাজারে পাওয়া যায়। ভারত উপমহাদেশেই সম্ভবত বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল  

 

বেগুনের জলবায়ু মাটি

বাংলাদেশে সারা বছরই বেগুনের চাষ হলেও রবি মৌসুমই সব জাতের বেগুন চাষের জন্য অধিকতর উপযোগী। দো-আঁশ বেলে দো-আঁশ পলিমাটি মাটি বেগুন চাষের জন্য বেশী উপযোগী

বেগুনের জাত

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের বেগুনের চাষ হয় জাতগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উত্তরা, তারাপুরী, কাজলা, নয়নতারা, ইসলামপুরী, খটখটিয়াবাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অবমুক্তায়িত বাউ বেগুন-, ব্রাক সিড এন্টারপ্রাইজ এর (সুরভি,জায়েন্টগ্রিন), গুলাবি লং (ন্যাশনাল এগ্রিকেয়ার), শিংনাথ(ইস্পাহানি সীডস্),ম্যাগাস ইকো আর্থ লিমিটেড এর (মী জ্যোতি) বেগুন পবন এবং হাইব্রিড বেগুন কাজল (এগ্রোজি সীড) ইত্যাদি উৎকৃষ্ট জাতের বেগুনের কিছু বৈশিষ্ট্য নিম্নে তুলে ধরা হলো

       
জাত                    ফলের আকার রং                       উৎপাদন মৌসুম     ফলন (হেক্টর প্রতি)    ঢলে পড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা    কান্ড ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা    
উত্তরা (বারি বেগুন-)      সরু, লম্বা, হালকা বেগুনী                   শীতকাল, আগাম জাত    ৬০-৬৫ টন               সহনশীল                             মাঝামাঝি প্রতিরোধক   
তারাপুরী (বারি বেগুন-)   বেলুনাকৃতি, কালচে বেগুনী                        শীতকাল            ৭৫-৮৫ টন              প্রতিরোধক                               প্রতিরোধক নয়   
কাজলা(বারি বেগুন-)      মাঝারী লম্বা, কালচে বেগুনী, চকচকে            আশ্বিন-চৈত্র          ৫৫-৬০ টন    

সহনশীল                            মাঝামাঝি প্রতিরোধক   
নয়নতার(বারি বেগুন-)   গোলাকৃতি, উজ্জল কালচে বেগুনী                 আশ্বিন-চৈত্র          ৪৫-৫০ টন           মাঝামাঝি প্রতিরোধক                     মাঝামাঝি প্রতিরোধক   
ইসলামপুরী                  উল গোলাকার, আকারে বেশ বড়,              রবি মৌসুম             ৩৬ টন            মাঝামাঝি প্রতিরোধক                         প্রতিরোধক নয়   

                            রং চকচকে বেগুনী
শিংনাথ                     সরু, লম্বা, বেগুনী রংয়ের, পত্রকক্ষে         রবি খরিপ মৌসুম        ৩০ টন             মাঝামাঝি প্রতিরোধক                    মাঝামাঝি প্রতিরোধক 

                            এক বা একাধিক ফল ধরে
খটখটিয়া (লম্বা)            ফল দন্ডাকার, বেগুনী বর্নের,                   রবি মৌসুম            ২৯ টন              মাঝামাঝি প্রতিরোধক                    মাঝামাঝি প্রতিরোধক  

                            শিংনাথ অপেক্ষা খাট মোটা
    

                      বারি বেগুন-                                                      উত্তরা

বারি বেগুন-      ডিম্বাকৃতি, সবুজ                          ভাদ্র - অগ্রহায়ন ফাল্গুন -বৈশাখ     ৪০-৫০ টন              সহনশীল                                সহনশীল  
বারি বেগুন-      চিকন, লম্বা, উজ্জল বেগুনী                 ভাদ্র - অগ্রহায়ন ফাল্গুন -বৈশাখ     ৪০-৪৫টন               সহনশীল                                সহনশীল   
বারি বেগুন-      চিকন, লম্বাকৃতি, উজ্জল কালচে বেগুনী      ফাল্গুন -বৈশাখ                       ৩০-৩২টন              প্রতিরোধী                                প্রতিরোধী   

বেগুনের জমি তৈরী, চারা উৎপাদন রোপন

জমি তৈরি    
জমি গভীর করে কয়েকবার চাষ দিয়ে আগাছা বেছে মাটি মোলায়েম করে জমি তৈরি করে নিতে হয়।

বীজ বপন চারা উৎপাদন
শীতকালীন বেগুন চাষের জন্য আগস্টের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন- এবং বর্ষাকালীন বেগুনের জন্য জানুয়ারীর প্রথম থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন- চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলায় বীজ বপন করতে হয়। বীজতলার মাটি প্রতি ভাগ ফরমালডিহাইডের সাথে ৫০ ভাগ পানি মিশিয়ে শোধন করে নিলে ভাল হয়। প্রথমে বীজ তলায় ঘন করে বীজ ফেলতে হয়। বীজ গজানোর ১০-১২ দিন পর গজানো চারা দ্বিতীয় বীজতলায়  'ানান- করা বাঞ্ছনীয়। বীজতলায় মাটি সমপরিমাণ বালি এবং কম্পোস্ট মিশিয়ে ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হয়। বীজ বপনের জন্য প্রতি বীজতলায় (৩দ্ধ১ বর্গ মি.) প্রায় গ্রাম বীজ দরকার হয।
চারা রোপণ
- সপ্তাহ বয়সের চারা ৭৫ সেমি দূরত্বে সারি করে ৬০ সেমি দূরে দূরে রোপণ করতে হয়। বিভিন্ন জাতের বেগুন গাছের আকার অনুযায়ী দূরত্ব ১০-১৫ সেমি কম বেশি করা যেতে পারে

বেগুনের সার প্রয়োগ

সার প্রয়োগ


উত্তরা জাতের জন্য নিম্নরূপ পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হয়।
সার    মোট পরিমান* (হেক্টর প্রতি)    শেষ চাষের সময় দেয়    মাদায় প্রয়োগ    পরবর্তী পরিচর্যা হিসাবে দেয়   
               
১ম কিসি-  (রোপনের ২১ দিন পর)    ২য় কিসি -(রোপনের ৩৫ দিন পর)    ৩য় কিসি- (রোপনের ৫০ দিন পর)   
গোবর    -১২ টন    অর্ধেক    অর্ধেক    -    -    -   
ইউরিয়া    ৩৭০-৩৮০ কেজি    -    এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ   
টিএসপি    ১৪৫-১৫৫ কেজি    -    সম্পুন্ন    -    -    -   
এমপি    ২৪০-২৬০ কেজি    -    এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ    অবশ্ষ্িট এক তৃতীয়াংশ   
জিপসাম    ৪০ কেজি    -    সম্পুন্ন    -    -    -   
সুত্র: ) কৃষি প্রযুক্তি হাত বই, বি..আর.আই জয়দেবপুর।  

*
জমির উর্বরতা ভেদে সার এর পরিমাণ পরিবর্তিত হতে পারে।

দেশী জাতের বেগুন যেমন ইসলামপুরী, খটখটিয়া, শিংনাথ ইত্যাদির ক্ষেত্রে সারের পরিমাণ ২৫% কম দিলেও চলবে

বেগুনের অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা

চারা রোপণের মাসখানেক পর থেকে মাঝে মাঝে গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিতে হয়। গাছের সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য শুষ্ক মৌসুমে সেচের খুবই প্রয়োজন। বেলে মাটিতে শীতকালে ১০/১৫ দিন অন- অন- সেচ দেয় প্রয়োজন। তাচাড়া প্রত্যেক কিসি- সার
প্রয়োগের অব্যবহিত পরে সেচ দেয়ার প্রয়োজন হয়। তবে মাটিজোদেখেই সেচের ব্যবস' নিতে হবে। গাছের গোড়ার দিকের -১০ ইঞ্চির মধ্যে গজানো পাশ্ব কুঁশি সমুহ ভেঙ্গে দিতে হবে

বেগুনের পোকা মাকড়

ফল কান্ড ছিদ্রকারী পোকা
ফল কান্ড ছিদ্রকারী পোকা বেগুনের প্রধান শত্রু। পোকার কীড়া, কান্ড, ডগা ফল ছিদ্র করে ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে এবং আক্রান- অংশ শেষ পর্যন্ত পচে যায়। ডগা আক্রান্ত হলে কচি ডগা ডলে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়। আক্রান্ত ফলের ভিতরটা ফাঁপা বিষ্টায় পরিপুন্ন থাকে।
দমন ব্যবস্থাঃ
১। গাছের আক্রান্ত নেতিয়ে পড়া ডগা আক্রান্ত ফল কেটে অপসারণ এবং ধ্বংশ করে।
২। সেক্স ফেরোমন ফাঁদ দিয়ে পুরুষ মথ ধরে এবং পরবর্তীতে তা ধ্বংশ করে

৩। ফিলটাপ ৫০ এসপি ১২ গ্রাম/ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
৪। রিপকর্ড বা সিমবুস মিলি প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।

তবে সমম্বিত বালাই দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে পোকা দমন করা সবচেয়ে উত্তম। ব্যবস্থার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে হবেঃ

) বেগুন ক্ষেতে প্রতি সপ্তাহে জরিপ করে ডগা ফলে মাজরা পোকার উপস্থিতি যাচাই করতে হবে

) আক্রান্ত - ডগা   ফল কীড়াসহ ছিঁড়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে

) পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে

) একই জমিতে প্রতিবছর বেগুনের চাষ করা যাবে না।

) স্থানীয় ভাবে পরীক্ষিত যে সকল বেগুনের জাতে পোকার আক্রমণ কম হয় সে সকল জাতের বেগুনের চাষাবাদ করতে হবে।

জ্যাসিড বা স্যামা পোকা
জ্যাসিড বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে বেগুনের একটি প্রধান ক্ষতিকর পোকা। এটি একটি বহুভোজী পোকা। বেগুন ছাড়া আলু, ঢেঁড়শ, মরিচ, কুমড়াজাতীয় সবজী, তুলা ইত্যাদি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে।  জ্যাসিড পোকা দেখতে খুব ছোট এবং হালকা সবুজ রংয়ের। সাধারণত পাতার নিচে লুকিয়ে তাকে। পুর্নাঙ্গ অপুর্নাঙ্গ উভয় পোকাই পাতা থেকে রস চুষে খায়। আক্রান্ত পাতা বিবর্ন হয়ে যায় এবং কচি পাতা কুচকে যায়। আক্রান্ত পাতা নিচের দিকে কুঁকড়ে যায়। পরে পাতার কিনারা হলুদ এবং পাতায় মরিচা রং হয়। একটি গাছের সমস্ত পাতা এমনকি সম্পুন্ন ক্ষেত ধ্বংশ হয়ে যেতে পারে।
দমনঃ

) পাতা কাটা যুক্ত বেগুন জাত চাষ করতে হবে কারণ কাটাযুক্ত বেগুন গাছে আক্রমন কম হয়

) ফাঁদ হিসেবে ক্ষেতের চারদিকে ঢেঁড়শ গাছ রোপণ করা যেতে পারে

) আক্রান্ত গাছ ধ্বংশ করতে হবে এবং পরিস্কার পরিছন্ন চাষাবাদ করতে হবে

) ডায়াজিনন ৬০ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৩০ মিলি মিশিয়ে সেপ্র করতে হবে

বেগুনের রোগবালাই

ঢলে পড়া রোগঃ
১। রোগ প্রতিরোধী জাত রোপন;
২। আক্রান- গাছ তুলে ধ্বংশ করা;
জংলী বেগুন বা বন বেগুনের সাথে জোড় কলমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করা।
৪। একই জমিতে বেগুন টমেটো পরপর লাগানো উচিত নয়।

ক্ষুদে পাতা রোগঃ
গাছের পাতার স্বাভাবিক বৃদ্ধি পরিবর্তিত হয়ে গাতার আকার ছোট ছোট হয়ে যায়, পুরু হয়ে যায়।
১। রোগ প্রতিরোধী জাত রোপণ;
২। আক্রান- গাছ তুলে ধ্বংশ করা;
৩। একই জমিতে বেগুন টমেটো পরপর লাগানো উচিত নয়।
৪। চারা রোপণের সময় চারার গোড়া টেট্রাসাইক্লিনের ১০০০ পিপিএম দ্রবনে চুবিয়ে রোপণ করা যায় এবং রোপণের পর - সপ্তাহ
    
পর্যন- সপ্তাহে এই দ্রবণ সেপ্র করা যায় তাহলে রোগ সংক্রামনের সম্ভাবনা কম থাকে।
৫। আগাম চারা রোপণ করা। জুলাই আগষ্ট মাসে রোপিত চারার চেয়ে জুনের প্রথমে রোপিত চারায় রোগ কম হয়।
৬। কাটা বেগুন, তিতা বেগুন, টমেটো, আলু, মিষ্টি আলূ ইত্যাদি বাহকের বিকল্প পোষক। অতএব এসব ক্ষেতে রাখা যাবে না।
গোড়া পচা রোগ
১। গোড়া পচা রোগ দমনের জন্য ভিটাভেক্্র-২০০, গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
২। একই জমিতে বেগুন টমেটো পরপর লাগানো উচিত নয়। আক্রান- গাছ দেখামাত্র তুলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে

বেগুনের জোড় কলম পদ্ধতি

টমেটো বেগুনের জোড় কলম প্রযুক্তিঃ
ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ শিকড়ের গিট রোগ বেগুন আগাম টমেটোর ব্যাপক ক্ষতি করে। মাটি বাহিত রোগ প্রতিরোধী রুট ষ্টক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। সাধারণত কাটা বেগুন পীত বেগুন এর চারা রুট ষ্টক হিসেবে ব্যবহার করে জোড় কলম করা হয়।

জোড় কলম তৈরী পদ্ধতিঃ


কলম গাছের পরিচর্যাঃ

·         বেগুনের ফসল সংগ্রহ ফলন

·         ফসল সংগ্রহ
বীজ বুনার পর থেকে জাত বিশেষে ফুল আসতে ৬০-৯০ দিন এবং ফুল ফোটার পর থেকে ফসল সংগ্রহ শুরু করতে গড়ে ৩০ সময় লাগে। ফল এমন পর্যায়ে সংগ্রহ করতে হবে যখন ইহা যথেষ্ট বড় হয় অথচ বীজ শক্ত হয়না।


ফলন
সাধারণত হেক্টর প্রতি ৩০-৪০ টন বেগুন উৎপন্ন হয়। তবে তারাপুরী (বারি বেগুন-) জাতটি সর্বোচ্চ ৭৫-৮৫ টন পর্যন- ফলন দিতে পারে।